ঢাকাবুধবার, ১১ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, রাত ৯:১৯
আজকের সর্বশেষ সবখবর

রাত সোয়া দুইটার গল্প

সংগ্রহ - দীপক চন্দ্র দে
মে ৩১, ২০২৫ ৮:৩৬ অপরাহ্ণ
পঠিত: 58 বার
Link Copied!

নিজাম মল্লিক নিজু- নাট্যকার,সিনিয়র সাংবাদিক ও সম্পাদক

👤রিয়াদ সম্ভবত থার্ড ইয়ারের ছাত্র। সে রংপুর মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র।
রিয়াদের আব্বা অর্থ্যাৎ আমার সেঝো দুলাভাই সৈয়দ রবিউল আলম। একদিন বাসায় না পেয়ে আম্মাকে বলে গেল আমি যেনো তার সাথে দেখা করি।
সৈয়দ রবিউল আলম।
তার বাবা সৈয়দ আব্দুল ওয়াদুদ ছিলেন আমার তৃতীয় মামা। ডাক নাম ছিলো জুজু। যেমন ছিলেন সাহসী তেমনি ছিলেন জেদী এবং রাগী। জুজুর নামের সাথে তার মিল খুঁজে পাওয়া যেতো। সবাই তাকে জুজু মিয়া বলে ডাকতো । তার নিজস্ব একটি কালচে ঘোড়া ছিলো। ময়মনসিংহে জেলা পরিষদের তিনি সদস্য ছিলেন। তাই গফরগাঁও-ময়মনসিংহে তিনি যাতায়াত করতেন তার নিজস্ব ঘোড়াটি দিয়ে।
গফরগাঁওয়ের সংশ্লিষ্ট এক জমিদার ছিলেন। জমিদার জুজু মামাকে সমীহ করতেন। একদিনতার কর্মচারি মাথা নত করে তার সাথে কথা বলেনি। তিনি রাগে- ক্ষোভে সোজা ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যান জমিদারের বৈঠকখানায়। জমিদার ছিলোনা বলে তার রাগ আরও বেড়ে যায়। তিনি তছনছ করে চলে আসেন জমিদারের বৈঠকখানা থেকে। এসব আম্মার কাছ থেকে শোনা। একবার রাত গভীরে তিনি ঘোড়া থেকে নেমে জ্বীনকে ধাওয়া দিয়েছিলেন।
সেই পিতার একমাত্র সন্তান আমায় ডেকেছেন। আমাকে তো যেতেই হবে।
আমার একটা নর কঙ্কাল লাগে। ইতস্হত রিয়াদের আব্বা। আমার পল্টি খাওয়ার মতো অবস্হা। বললাম. কন্কাল!আমি আমার নিজের কণ্কালের উপস্হিতি অনুভব করলাম। বললাম. ভাইসাব। এই মুহূর্তে আমারটাই নিয়ে যান। না। ফাইজলামি না। রিয়াদের একটা কন্কাল লাগে। পারবা?
আমি পূর্ণ দৃষ্টিতে দুলাভাইকে দেখার চেষ্টা করি। তার চোখে শত পার্সেন্ট প্রাপ্তিযোগ। যেন আস্ত একটা নরকঙ্কাল তাকে সালাম করতে আসছে।
কি পারবা? পারবা? রিয়াদের আব্বার সেকি উত্তেজনা। আমি দুলাভাইকে আশ্বস্হ করি। আরে সাইব আস্ত একটা নরকংকাল কব্বরখানা থেকে হেটে এসে আপনাকে কদমবুচি করবে।
( দুই)
আমার এক অগ্রজ বন্ধু আছে। তিনি আবার আমার আড্ডারও বন্ধু। তিনি
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে অধ্যাপনা করেন। মানুষের মৃতদেহ পরীক্ষা-নিরীক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন অর্থ্যাৎ লাশ কাটাকুটিতে তিনি খুব আনন্দ পান এবং এতে তিনি সিদ্ধহস্ত।
ডাঃ আবুল মনসুর। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে খুব চৌকস চিকিৎসক। পাক্কা বুদ্ধি। পাক্কা হাত।
ফোন দিলাম। আপনে কই?
জবাব এলো লাশকাটা ঘরে। শুনেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
বললামঃ আমি আসছি।
গিয়ে দেখি এলাহি কান্ড। মর্গের বারান্দায় বিশাল বপুসম্পন্ন এক মহিলার মৃতদেহ। তার কপাল বরাবর হাতুড়ি বাটাল দিয়ে ডোমেরা সমানে বাইরাবাইরি করছে। মনে মনে বলি এইটার কংকালটা হলে মন্দ হয়না। রিয়াদের সুবিধা হবে। কিন্তু সময় তো নাই।
মনসুর ভাইয়ের চেম্বারে চা খেতে খেতে ভাগ্নের কংকালের প্রসঙ্গ তুলি। মনসুর ভাই মিটিমিটি হেসে বলেন. আমার কংকলটাই নিয়ে যান। হেসে বললাম আমি কিন্তু সিরিয়াস। মনসুর ভাই গোটা চারেক ডোমকে তলব করলেন। একজনের নাম ধরে বললেন. সীতারাম আমাকে একটা কংকালের ব্যবস্হা করে দিতে হবে।
সীতারাম তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে বলে উঠেঃ ডাক্তার সাহাব. বিওয়ারিশ কুনো লাশটাশ তো হামার কাচে নাহি।
সীতারাম ব্যবস্হা করো। তাহা নাহা অইলে সম্বাদিক সাহাব হামাকেই লাশ বানাইয়া ফালবে…. মনসুর ভাই ডোমের মতো করে কথাটা বলে মিটিমিটি হাসতে লাগলেন।
একটা বাউরিশ লাশ চুপিচুপি পুড়াইতেছি কিন্তুক পাঁচশত টাকা লাগবেক আর তিনদিন সুমোয় দিতে হইবেক।
ডাঃ আবুল মনসুর তিনশ টাকা তৎক্ষনাত দিয়ে বললেন যাও। কংকালের ব্যবস্হা করো। অক্কনি কামে লাগিয়া যাও।
মনসুর ভাই সীতারামকে আমার অফিসের ঠিকানা এবং ভিজিটিং কার্ড সীতারামকে দিয়ে কঠোর ভাষায় বলে দিলেন দেখো সিত্যারাম। সেইটা পরতিকা অফিস আচে। কুব সাবধান। মাল সামাল খাইয়া যাইবানা। রিপুট আসিলে নকরী খাইয়া দিবো।
আমি বুঝে নিলাম শালারা মদ্যপান করেই আসবে এতে কোন সন্দেহই নেই। আমাকে সেইভাবেই ব্যবস্হা নিতে হবে। মনসুর ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম কংকাল আমি পাবো।
( তিন)
বাসায় এসে পরদিন সকালে দুলাভাইয়ের সাথে দেখা করে বিস্তারিত আপগ্রেড দিলাম। দুলাভাই খুব খুশী হলেন তবে বলে দিলাম শালারা কিন্তু হারামজাদা। সবসময় বাংলা মদের উপর ভেসে থাকে।
তিনদিনের জায়গায় নয়দিনের মধ্যে সীতারাম ভেঙ্গে ভেঙ্গে আমাকে কংকালের ছাকনি. কোমর থেকে পায়ের পাতা. মাথার খুলি ইত্যাদি বিকেলের মধ্যে সাপ্লাই শেষ করলো। শেষে বাকি রইলো দুই হাতের কবজী সহ আঙ্গুল।
মনসুর ভাইকে ফোন দিলাম। জানালাম সবই দিয়েছে। এখন হাত নিয়ে খেলছে। বিষয়টা একটু দেখেন তো। আর সীতারাম আসলেই আমি এক বোতলের টাকা দিয়ে দেই। তার সাথে আরেকটা আসে তার নাম বাহাদুর।
মনসুর ভাই আমাকে একটু ম্যানেজ করে নিতে বলেন। বুঝেননা কংকালটাকে সিদ্ধ করে ভেঙ্গে আনতে হয়। আর সবসময়ই টালমাটাল থাকে।
এরপরের রাত দশটা নাগাদ সীতারাম আর বাহাদুর টলতে টলতে এসে হাজির। আমি তার হাতের দিকে লক্ষ্য করি। খুব মুডে আছে সীতারাম আর বাহাদুর। পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়ে বলতে থাকে সম( সাংবাদিক) সাহাব। এই কবজী আর কবজীর সঙ্গে আঙ্গুল। কাম কমপিলিট হইয়া গেল। একন দুইঠ্যা বুতুলের দাম দিয়্যা দেন। হামরা চলিয়া যাই।
রাগ নিয়ে বললাম আবার দুইটা বোতল কেন ?
এ্যাই যে সাহাব হামরা দুইজন আচি না ?
.হাত দিয়ে নিজেদেরকে দেখায়। এই যে হামি আর ওই যে বাহাদুর। কথাটা বলে আবার পড়ে যেতে চায়। দেখলাম. মহা মুশকিল। দুইটাকে তো দ্রুত বিদায় করতে হবে ।

বললাম ও আচ্ছা আচ্ছা। টাকা দুইশ দিয়ে কোনমতে দুইটাকে বিদায় করলাম। দুইটাকে দেখে আমার মনে হচ্ছিল দুইটাই জীবন্ত কংকাল।
( চার)
ঠিক আজকের মতোই সেদিনের রাতটা ছিলো। একদিকে কাজটা কমপ্লিট করার আনন্দ অন্যদিকে ভয়। শন্কা। মাঝে মাঝেই বিদ্যূৎ চলে যাচ্ছে। কাজ শেষ হয়েছে সত্তুর ভাগ। শেষ হতে সময় লাগবে রাত তিনটার মতো। কর্মচারীরা বলতে লাগলো বাই. আজকের রাতটা থেকেই যান। তার মধ্যে আবার মড়া মানুষের হাত নিয়্যা যাইবেন।
আমার মৃত মানুষের হাতের কথা মনে হয়ে গেলো। বুঝলাম মহা যন্ত্রণার মধ্যে পড়ে গেছি। ঝিরঝিরে বাতাস আর টিপ টিপ বৃষ্টি সারাদিনই পড়েছে এখনও পড়ছে।
রাত দুইটা। নূরু মিয়াকে বললাম বোতলের অর্ধেক হুইস্কিটা নিয়ে আসো। তাইলে যাইবেনই গা। পুরো অর্ধেকটা গলায় ঢেলে দিয়ে টিপটিপানি বৃষ্টি আর ঝিরঝিরে বাতাসের মধ্যেই রাস্তায় নেমে গেলাম। যাবার আগে আবার ব্যাগ খুলে হাত দুটো দেখে নিলাম।নিজেই চমকে যাই আর মনে মনে বলি আমার কোন ভয় নাই। উপরে মহান আল্লাহ। আমি গাঙ্গিনারপার মোড়ে আসলাম। কোন রিক্সা নেই। এমনকি একটা কুত্তাও নেই। আমার শরীরটা গরম আছে। চিন্তা করলাম আজ রাতটা আমার। হেটেই বাসায় যাবো। মড়া মানুষের হাত আমার ব্যাগে। আমি এটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছি। বৃষ্টি চলছে। বিদ্যাময়ী স্কুলের সামনে আসতেই দেখি পানির নহর বইছে। ইচ্ছা হলো ব্যাগটা পানিতে ভাসিয়ে দিই। কিন্তু ওটার ভেতরে যে আঙ্গুল। হাত। আবার মনে পড়ে গেলো।
ঝুম বৃষ্টি নামছে নামছে করছে। এর মধ্যে কারেন্ট চলে গেলো। আমার মধ্যে আনন্দ কাজ করছে।
নিজেকে ভাসিয়ে দিলাম ময়মনসিংহের বুকে। জিলা স্কুলের মোড়ে এসে দেখি ময়নার দোকান খোলা। হরিকেন জ্বালিয়ে গুটিসুটি বসে আছে। ময়না বললো বাই আইজ তো বেজায় রাইত হয়্যা গেলো। কোন কথা বললামনা। প্যান্টটা হাটু পর্যন্ত গুটিয়ে নিলাম। ব্যাগটা তুলতে গিয়ে আবার দুটি হাতের কথা মনে হয়ে গেলো।
বৃষ্টিটা গুড়িগুড়ি। জিরো পয়েন্টে চলছে। আমি সটান হাঁটতে শুরু করলাম। হাটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। পিটিআই এর সামনে আসতেই গাড়ীর সার্চ লাইট আমার চোখ ঝলসে দিলো। ধীরে ধীরে গাড়িটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে গেলো।
টহল পুলিশের গাড়ী।
বামদিকে গলা বের করে ভরাট গলায় বললো থানার ওসি। আজকে এতো দেরী। তার মতো করেই বললাম কারেন্ট নাই। আমি পাচ পা এগুতেই দেখি সামনে সমুদ্দুর। সানকীপাড়া রেললাইনের আগে তিন রাস্তার মোড়ের পানি সমুদ্র সঙ্গমে মিলিত হয়েছে। কোমর পানি। সেই সাথে প্রবল স্রোত। আমি শরীর এলিয়ে দিলাম। আল্লাহ ভরসা। হাত দুটো উপরে তুলে ব্যাগ ধরে রেখেছি। ডানে গোরস্তান। আমার দুই হাতের কবজী আর আঙ্গুলের কথা মনে পড়ে গেলো আবার।
প্রায় দশ মিনিট পানির দোলাচলে চলছি। হঠাৎ ডানে তাকাই। কি যেনো একটা কিছু পানির স্রোতে ভেসে আসছে। ব্যাগটা বাম হাতে ধরে ডান হাতটা রাখি সেটার উপর। কুৎকুৎ করতেই চমকে হাত সরিয়ে নিলাম৷ একটা কুকুরের শাবক। আবার আনন্দ পেলাম। যা হোক কেউ আমার সাথে আছে। মনে মনে বললাম জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর। আমি কুকুর ভাইয়াকে সাথে নিয়ে রেললাইনে উঠলাম। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চতূর্দিকে তাকিয়ে দেখলাম এই নশ্বর পৃথিবীতে আমরা দুটি প্রাণি এখনও আছি জেগে। একজন আমি আরেকজন একটি সারমেয়। নিজেকে ময়মনসিংহের প্রিন্স মনে হতে লাগলো।
একটু রেস্ট নিয়ে এবার লম্বা হাঁটা সাথে দৌড়। যতোই বাসার দিকে আসছি কেনজানি ততোই ভয় বেড়ে যাচ্ছে। কার না কার হাত। না জানি কখন ব্যাগ ফুঁড়ে আমার গলা চেপে ধরে বলে উঠবে কাত্যায়ণ বধ করো। যতোই বাসার দিকে এগিয়ে আসছি ততোই নানান কূচিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বৃষ্টির গতি বেড়ে গেলো। আমি দৌড় শুরু করে দিলাম। শচীণ কর্তার গানটা উল্টো করে হেড়ে গলায় গেয়ে যাচ্ছি… আমি আর নেই তো আমি.. রাত কয়টা হলো জানা নাই।
উৎসর্গঃ ডাঃ সৈয়দ শরীফুল আলম রিয়াদ
31.5.25 saturday. at night 2.10 am.

এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।